Thursday, July 5, 2012

কলকাতার পথকথা | Anandabazar

কলকাতার পথকথা | Anandabazar

কলকাতার পথকথা

গৌতম বসুমল্লিক

মুঘল বাদশাহের আমন্ত্রণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠিয়াল জব চার্নকের তৃতীয় বারের জন্য সুতানুটির ঘাটে আশ্রয় নিয়েছিলেন ১৬৯০-এর ২৪ অগস্ট তারিখে। সেই ঘটনাকে যদি এই শহরের সূচনা বলে ধরে নেওয়া হয় তা হলে কলকাতার বয়স দাঁড়ায় প্রায় তিনশো বাইশ বছর। এক জলা-জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল দীর্ঘ প্রায় সোয়া তিন শতক ধরে কালক্রমে পরিণত হল বহুজাতিক, বহুমাত্রিক শহরে।
চার্নক যখন সুতানুটির ঘাটে পা রেখেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে অঞ্চলটির চেহারা কেমন ছিল তার স্পষ্ট কোনও ইতিহাস পাওয়া যায় না। খণ্ড-বিচ্ছিন্ন কিছু বিবরণ থাকলেও উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই, ১৬৯৩-এর ১০ জানুয়ারি চার্নক মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর কোম্পানির কমিশরি জেনারেল এবং কুঠিগুলির চিফ গভর্নর জন গোল্ডসবেরাকে পাঠানো হল সুতানুটির হাল ধরতে। গোল্ডসবেরার কিন্তু পছন্দ হল না জায়গাটি। তিনি কিছু পরিকল্পনা করলেন বটে কিন্তু তা বাস্তবায়িত হবার আগে ওই বছরেই নভেম্বরে তিনি মারা গেলেন কলকাতাতেই। এর পর কোম্পানির কর্তাদের ইচ্ছাতে চার্নকের জামাই চার্লস আয়ারকে মাদ্রাজ থেকে এনে তাঁর উপরে কুঠির ভার দেওয়া হল। চার্লস আয়ার ১৬৯৮-এর ১০ জানুয়ারি বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের কাছ থেকে তেরোশো টাকার বিনিময়ে ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘কলকাতা’ নামের তিনটি ডিহি বা পরগনার ‘প্রজাস্বত্ব’ কিনে নিলেন কোম্পানির কুঠি নির্মাণের জন্য। এই ঘটনার প্রায় এক দশক পরে, ১৭০৭-এ এক জমি জরিপের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, সেই সময়ে এখানে প্রধান রাস্তা ছিল মাত্র একটি, সাহেবদের ভাষায় তার নাম ‘পিলগ্রিম রোড’ বা তীর্থযাত্রীদের রাস্তা। তার দুটি ভাগ। একটি হল, চিৎপুর খালের কাছ থেকে আরম্ভ হয়ে চাঁদনির খাল পর্যন্ত রোড। যার পুরনো নাম চিৎপুর রোড আর বর্তমান নাম ‘রবীন্দ্র সরণি’। চিৎপুর নামটা এসেছে ‘আদি চিত্তেশ্বরী’ নামে এক দুর্গা মন্দির থেকে (এখনকার ঠিকানা ৯ খগেন চ্যাটার্জি স্ট্রিট)। অনেক কাল আগে, মনোহর ঘোষ নামে এক ব্যক্তি ওই জায়গায় একটা দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরে ওই জায়গাটা ডাকাতদের আড্ডায় পরিণত হয়। শোনা যায়, চিতু নামে এক ডাকাত ওই মন্দিরে পুজো দিয়ে ডাকাতি করতে বেরোত। কেউ কেউ বলেন, চিতু ডাকাতের ঈশ্বরী (দেবতা) থেকেই ওই দুর্গামূর্তির নাম হয়েছে চিত্তেশ্বরী। সায়েবরা রাস্তাটাকে বলত ‘রোড টু চিৎপুর’, অর্থাৎ চিৎপুর যাওয়ার রাস্তা। পরে সেটাই পরিণত হয় চিৎপুর রোড-এ। আরও পরে রাস্তাটির দক্ষিণ অংশের নাম হয় বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট আর উত্তর অংশের নাম হয় রবীন্দ্র সরণি।
আর অন্যটা চৌরঙ্গির জঙ্গল ধরে সোজা কালীঘাট পর্যন্ত। যার বর্তমান নাম জওহরলাল নেহরু রোড। জায়গাটি আগে ছিল ঘোর জঙ্গল। ‘চৌরঙ্গী’ বা ‘চৌরঙ্গি’কে অনেকে আবার ‘চিরাঙ্গী’ বা ‘চেরাঙ্গী’ও বলেন। শব্দটি এসেছে পুরাণের গল্প থেকে। সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর মৃতদেহ নিয়ে মহাদেবের প্রলয়নৃত্যের সময় বিষ্ণুর চক্রের আঘাতে সতীর দেহের বিভিন্ন অংশ নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন নাকি ওই জঙ্গলে সতীর বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের অংশ পড়েছিল। চেরা অঙ্গ থেকেই নাকি চেরাঙ্গী নাম! আবার অনেকে বলেন, ওই অঞ্চলে ঘন জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী নামে এক সন্ন্যাসী থাকতেন। তাঁর নামানুসারেই অঞ্চলটি চৌরঙ্গী বা চৌরঙ্গি নামে চিহ্নিত।
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে নানা মানুষজন আসতে থাকে কলকাতায়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়তে থাকে বাড়িঘর এবং সেই সঙ্গে রাস্তাও। প্রথম যুগে তৈরি শহরের দীর্ঘ রাস্তাগুলির অন্যতম হল সার্কুলার রোড। এটি কিন্তু প্রথমে রাস্তা ছিল না, ছিল খাল। বর্গিদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ১৭৪২ নাগাদ শহর ঘিরে যে ‘মারাঠা খাদ’ বা ‘মারহাট্টা ডিচ’ খোঁড়া হয়েছিল, ১৭৯৯-এ সেই সেই খাদ বা খাল বুজিয়ে তৈরি হয় সার্কুলার রোড। পরে রাস্তাটি আপার ও লোয়ার সার্কুলার রোড, এই দুই নামে বিভক্ত হয়ে যায়, যাদের বর্তমান নাম যথাক্রমে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড ও আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড।
কলকাতা শহরের প্রকৃত নগরায়ণ আরম্ভ হয় পলাশির যুদ্ধের পর থেকে। ইউরোপে যেমন বলা হয়, ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন এ ডে’, কলকাতার ক্ষেত্রেও এই কথা সমান ভাবে প্রযোজ্য। পলাশির যুদ্ধের পর নতুন নবাব মির জাফর আলির সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তির ফলে মারহাট্টা ডিচের অন্তর্গত সমস্ত এলাকা তো বটেই, সেই সঙ্গে সন্নিহিত আরও ২০টি মৌজার শুল্কহীন অধিকার দখল করে নেয় কোম্পানি। এ ছাড়া নবাবের কাছ থেকে আগের নবাব সিরাজদ্দৌলার কলকাতা অবরোধের ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া গেল আরও ১ কোটি সত্তর লক্ষ টাকা। এই টাকার কিছু অংশ ব্যয়িত হয় কলকাতার নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণে আর বাকি টাকায় ইংরেজরা গোবিন্দপুর অঞ্চলে নতুন কেল্লা নির্মাণ করে। পুরনো কেল্লার নামেই হয় তার নামকরণ— ফোর্ট উইলিয়ম।
একেবারে গোড়ার দিকে শহর গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল জমিদারদের হাতে। এই শহরের প্রথম জমিদারের নাম সিডনি শেলডন। ১৭৯৪ থেকে জাস্টিস অব পিস-দের হাতে। লটারি কমিটি প্রথম তৈরি হয় ১৭৮৪ নাগাদ, সেন্ট জনস গির্জা তৈরি হবার সময়ে। এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০৫-এ থেকে লটারি কমিশন গঠন করেন। ১৮১৭ থেকে লটারি কমিটি কলকাতা শহরের রাস্তাঘাট নির্মাণ করত। ১৮৭৬-এ জন্ম হয় কলকাতা পুরসভার।
লটারি কমিটি কলকাতা শহরের বহু উল্লেখযোগ্য রাস্তা তৈরি করেছিল। সেগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় পার্ক স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজারের মোড় ছাড়িয়ে মারাঠা ডিচ অবধি দীর্ঘ রাস্তাটির কথা। রাস্তাটি— ওয়েলেসলি স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট ও কর্নওয়ালিস স্ট্রিট এই চারটি ভাগে বিভক্ত। ওই রাস্তাগুলির বর্তমান নাম, যথাক্রমে রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড, নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিটের নাম অপরিবর্তিত আছে এবং বিধান সরণি। স্থানীয় মানুষের পানীয় জলের জোগান বাড়াতে ওই রাস্তাগুলির পূর্বপ্রান্তে রাস্তার নামে নামে একটি করে পুকুর খোঁড়া হয়েছিল। সেগুলির বর্তমান নাম, যথাক্রমে হাজি মহম্মদ মহসীন স্কোয়ার, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, বিদ্যাসাগর উদ্যান ও আজাদ হিন্দ বাগ। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের পুকুরটি এখন আর নেই, ভূগর্ভস্থ জলাধারে রূপান্তরিত করা হয়েছে সেটিকে।
চার্নকের আগমনের পর থেকে কেটে গেছে তিনশো বছরেরও বেশি সময়। এত বছরে কলকাতার পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই। অ্যাডেড-এরিয়া বাদ দিয়ে কলকাতা পুরসভার ১০০টি ওয়ার্ডে অ্যাভিনিউ, রোড, স্ট্রিট, সরণি, লেন, বাই-লেন, রেঞ্জ, প্লেস, স্কোয়ার ইত্যাদি মিলিয়ে রাস্তার সংখ্যা প্রায় ২৩০০-র কাছাকাছি। ওই সব রাস্তার বেশির ভাগটাই তৈরি হয়েছে আঠারো ও উনিশ শতকে। প্রথম দিকে রাস্তার নামকরণ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি ছিল না। এলাকার বৈশিষ্ট্য দিয়েই চিহ্নিত হত পথনাম। যেমন, ‘নেটিভ পাড়ার’ অর্থাৎ, দেশীয় লোকেদের আবাসস্থলের বেশির ভাগ রাস্তাই তাই বিভিন্ন ‘বাগান’, ‘বাজার’, ‘মন্দির’, জীবিকাবাচক ‘টোলা’ বা ‘টুলি’ (চালাঘর), ‘পাড়া’, ‘জলাশয়’ ইত্যাদির নামে। স্বাধীনতা-উত্তর কালে তাদের অনেকগুলিরই নতুন নামকরণ হয়েছে। বন্ধনীতে নতুন নামসহ সে সব রাস্তার কয়েকটি হল— মেছুয়াবাজার স্ট্রিট (মদনমোহন বর্মণ স্ট্রিট), নেবুবাগান লেন (বঙ্কিম মুখার্জি সরণি), সিমলাই পাড়া লেন (ড. সুভাষ লেন), ষষ্ঠীতলা রোড (অটলবিহারী বোস লেন), মুরারীপুকুর রোড (বিপ্লবী বারীন ঘোষ সরণি) ইত্যাদি। আর সায়েবপাড়ায় অধিকাংশ রাস্তার নামই ছিল বিভিন্ন ইংরেজ রাজপুরুষ, প্রশাসকদের নামে। পরবর্তীকালে সেই সব রাস্তা কৃতবিদ্য ভারতীয় ও আঞ্চলিক বিখ্যাত মানুষদের নামে পরিবর্তিত করা হয়।

অ-মানুষ নামে এক প্রজাতি | Anandabazar

অ-মানুষ নামে এক প্রজাতি | Anandabazar

অ-মানুষ নামে এক প্রজাতি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


মানুষ কেন অন্য মানুষকে মারে, খুন করে? অনেকদিন ধরেই এই প্রশ্নটা খচখচ করে আমার মনে। আদিমকালে মানুষ যখন বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়েছিল, তখন থেকেই হিংসা ও হানাহানির শুরু, আজও সেই একই রকম কাণ্ড-কারখানা চলছে। ইংরিজিতে রেস মেমরি বলে একটা কথা আছে, অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে, বংশ পরম্পরায় মানুষ দু’একটি স্মৃতি বহন করে, যা সে নিজেও জানে না। আদিমকাল থেকে সেই হিংসার স্মৃতিতে মানুষ যখন তখন খুনি হয়ে ওঠে। বাঘ কখনও অন্য বাঘকে মারে না, রাস্তার কুকুর যখন সীমান্তরক্ষার তাগিদে অন্য একটা কুকুরের সঙ্গে মারামারি করে, কী হিংস্র তাদের গর্জন, সাঙ্ঘাতিক হুটোপাটি, কিন্তু কোনও কুকুরই মরে না, কিছুক্ষণ পরে ওদের একজন হার স্বীকার করে, ল্যাজ গুটিয়ে পালায়, পিঁপড়েরা অন্য পিঁপড়েদের খুন করে না। একই প্রজাতির মধ্যে খুনোখুনির কলঙ্ক একমাত্র মানুষেরই। বাইবেলেও আছে, ভ্রাতৃহত্যা দিয়েই মানুষের ধারার শুরু।
ক’দিন ধরে আমার মনে হচ্ছে, আসলে কোনও মানুষই অন্য মানুষকে হত্যা করে না। অত্যন্ত রাগ আর রিরংসায় কিংবা নারীর ওপর অধিকার বা অর্থ লালসায় কোনও কোনও মানুষ হঠাৎ অমানুষ হয়ে যায়, তখন অন্যের প্রাণ হরণে তার হাত কাঁপে না। সে তখন আর মানুষ থাকে না, অ-মানুষ নামে অন্য এক প্রজাতি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে যে নিহত হয়, সে-ও আর মানুষ নয়। এইসব অমানুষদের অবয়ব দেখে কিছুই বোঝা যায় না।
পৃথিবীতে জনসংখ্যা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে অ-মানুষদের সংখ্যা? মানুষের সঙ্গে অমানুষদের একটা গোপন যুদ্ধ চলছে তো চলছেই।